ঈদের আরো সাতদিন বাকি আছে। এক সপ্তাহ বাকি থাকতেও ইকবাল হোসেন কেন গরু কিনে ফেললেন এই নিয়ে তার স্ত্রীর ক্ষোভের শেষ নেই। উঠতে বসতে কান তার ফালাফালা করে দিচ্ছে।
এত আগে কেন গরু কিনলে? সাতদিনতো আরো বাকি ছিলো। এই সাতদিনে দামটা কি কমতো না? মনে নেই গতবার পাশের ফ্লাটের সালাউদ্দিনের আব্বা চানরাতে গিয়ে কি গরু কিনেছিলো? এক লাখ টাকার গরু সত্তর হাজারে পেয়েছিলো। এত তাড়াহুড়ো কেন তোমার? ধৈর্য শক্তি কি ভেতরে একেবারে নেই?
ইকবাল হোসেন দুই কানে আঙুল দিয়ে চুপ করে সোফায় বসে আছেন। তার চোখদুটিও বন্ধ। তিনি এখন কিছুই দেখছেন না, কিছু শোনছেনও না। কানে আঙুল দেওয়ার আগে স্ত্রীকে খুব করে বুঝিয়েছেন, দেখো সাবিনা আমি যদি এটা ব্যবসার উদ্দেশ্য কিনতাম তাহলে তাহলে তুমি এই লাভ ক্ষতির কথা বলতে পারতে। কিন্তু আমি গরু কিনেছি কোরবানি দেওয়ার জন্য৷ আল্লাহকে খুশি করার জন্য। এখানে লাভ ক্ষতির হিসাব টানা অনুচিত।
স্বামীর এমন বাণী কথা মোটেও কানে তোলেনি সাবিনা বেগম। বিরামহীন ভাবে বকবক করেই যাচ্ছে। শত শত ছেলে মেয়ে মানুষ করার কারিগর শিক্ষক মো ইকবাল হোসেন নিজের স্ত্রীকে মানুষ করতে পারলেন না। এই নিয়ে তার মনে দুঃখ প্রবল। কখনো কখনো তার মনে হয় পরকালে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য এমন একজন হিংসুটে আর ঝগড়াটে স্ত্রী-ই যথেষ্ট হবে।
সাবিনা বেগমের বকবকানি আরো বেড়েছে। কানে আঙুক দিয়েও এখন আর কাজ হচ্ছে না। আঙুল সরিয়ে ইকবাল হোসেন ধমকের সুরে বললেন, দয়া করে এবার একটু চুপ করবে? ঘরে উপযুক্ত দুই মেয়ে আছে। তোমার এমন আচরনে ওরা কি শিখছে সেটা বুঝতে পারছো?
সাবিনা বেগম কিছু বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হলো না। বুঝতে পারলে চুপ করে যেতো। তার গলার জোর আরো বেড়েছে। চেচানো গলায় চার দেওয়ালের ভেতরটা বিভৎ করে ফেলেছে৷ এমন অবস্থায় ঘরে থাকা কঠিন ব্যাপার। ইকবাল হোসেন ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। তার প্রচন্ড মাথা ধরেছে৷ এখন তিনি যাবেন ভাই ভাই ফার্মেসীতে। সেখান থেকে দুটো রিলাক্সিন খেয়ে আগে মাথা ঠান্ডা করবেন।
রিলাক্সিনে ভালো কাজ করেছে। ইকবাল হোসেনের মাথা ধরাটা যথেষ্ট কমেছে। তিনি এখন গ্রাউন্ড ফ্লোরে আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসে আছেন। গ্রাউন্ড ফ্লোরে কোন ঘর নেই। এখানে গ্যারেজ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই বিল্ডিংয়ে কারো গাড়ি নেই। বাইরের কোন গাড়ি এখানে ভাড়ায় রাখা হবে কি না সেই বিষয়ে আগামি সপ্তাহের মিটিংয়ে সিদ্বান্ত নেওয়া হবে। এই মূহর্তে ফাকা ফ্লোরে তার কোরবানির কালো গরুটা আপন মনে খড় খাচ্ছে।
স্যার কি ঘুমাচ্ছেন নাকি?
ইকবাল হোসেন ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন তিন তলার মনোরঞ্জন বাবু দুঃখী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। এই বিল্ডিয়ে ভদ্রলোকের আগমন হয়েছে ছয় মাস হলো। এই ছয় মাসে মনোরঞ্জন বাবুকে কখনোই এমন দুঃখী মুখ করে থাকতে দেখা যায়নি। পাশের চেয়ারে তাকে বসার ইঙ্গিত করে ইকবাল হোসেন বললেন, বসুন মনোরঞ্জন বাবু। কিছু বলবেন?
মনোরঞ্জন বাবু বসলেন। আন্তরিক গলায় বললেন, স্যার আপনি শিক্ষক মানুষ। সবার শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তক। আপনাকে কিছু বুঝিয়ে বললে অবশ্যই আপনি সেটা বুঝবেন। এই বিশ্বাস নিয়েই আপনার কাছে এসেছি।
- আপনি কি আমাকে কিছু দেখাতে নিয়ে এসেছেন নাকি? আপনার হাতে ওটা কি?
মনোরঞ্জন বাবু হাতের কাগজটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, স্যার এটা দেখেন।
কি এটা, কথাটি বলে ইকবাল হোসেন কাগজটি হাতে নিলেন। কাগজটায় সুন্দর করে একটা গরুর ছবি আকা। তার নিচে দুই লাইনে দুইটি প্রশ্ন।
মনোরঞ্জন বাবু বললেন, স্যার আমি আপনার ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত কিংবা ধর্ম পালনে বাধা প্রদান করতে আসি নাই। দয়া করে আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।
ইকবাল হোসেন বার দুয়েক কপাল চুলকে ঠান্ডা গলায় বললেন, একটা ব্যাপার ভেবে দেখলাম বুঝলেন!
উৎসাহী গলায় মনোরঞ্জন বাবু বললেন, প্রশ্ন দুইটা যথেষ্ট যৌক্তিক তাই না?
- না, আপনার প্রশ্নগুলো খুব বেশি যৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে না।
- তাহলে ভেবে দেখলেন কি?
- ভেবে দেখলাম এটাই, আপনার এই প্রশ্ন দুইটার উত্তর না দিলে ক্ষতিটা আপনার চেয়ে বরং আমার-ই বেশি হবে। কাগজটা হাতে নিন আর মুখে প্রশ্ন করুন। আমি উত্তর দিচ্ছি ইনশাআল্লাহ।
মনোরঞ্জন বাবু কাগজটা হাতে নিলেন। স্বল্প শব্দে গলা ঝেড়ে প্রথম প্রশ্নটা করলেন-
- প্রাণী হত্যা অমানবিক। কিন্তু তাও আপনারা গরু জবাই করছেন। গরুর মাংস খাচ্ছেন। এই বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?
- দেখুন বিজ্ঞানের ভাষায় মানুষ মূলত মাংসাশী প্রাণী। পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য আমাদের অভ্যাসে চলে এসেছে। যার কারনে শাকসবজি সহ আমরা আরো অনেক কিছুই খেতে পারি। অনেক ক্ষেত্রে শরীরের জন্য মাংসের চাইতে শাকসবজি বেটার অপশন। কিন্তু কখনো কখনো আমাদের শরীরের প্রোটিন ব্রেকডাউন হয়ে আমিষ জাতীয় খাবার ভাঙতে ভাঙতে শেষ পর্যায়ে এসে যেই এমাইনেসিড হয়, সেই এমাইনেসিড আমাদের রক্তে শোষন হয়। আমাদের শরীরে বিভিন্ন এমাইনেসিড রয়েছে। কিছু এমাইনেসিড এমন আছে যেগুলোকে এসেনসিয়াল এমাইনেসিড বলা হয়।যেগুলো আমাদের শরীরের জন্য লাগবেই। এবং এগুলোর বেশিরভাগ-ই আসে বিভিন্ন প্রাণীজ সোর্স থেকে। তাই প্রাণী হত্যা অমানবিক এই কথাটা ধুপে টিকলো না।
আচ্ছা আপনার কথা মেনে নিলাম।আপনারা পশু হত্যা করেন ঠিক আছে। কিন্তু সেই পশু হত্যা করে উৎসব করেন কেন?
- আপনার ঘরে মেহমান আসলে আপনি মুরগি জবাই করছেন। কারো অনুষ্ঠানে গেলে মাংস খাচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পাঠা হত্যা করে উৎসব করছেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে আপনি কি বলবেন?
মনোরঞ্জন বাবু উঠে দাড়ালেন। বললেন, দেখুন আমাকে মনে হয় আরো প্রস্তুতি নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে হবে।
- এটা আপনার খুশি।
মনোরঞ্জন বাবু চলে গেলেন। যেতে যেতে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন কালো গরুটার দিকে।
ইকবাল হোসেন পুনরায় আরাম করে আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসলেন। এখন তিনি শান্ত মনে ভাববেন। তার ভাবনার বিষয় এই দুনিয়া আর পরকাল। আজকাল একটু খানি অবসর পেলেই এই দুটি বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তিনি।
সত্যমনা লেখক -
Monir Hossain.
COMMENTS