আজ মাহফুজুর রহমানের বছরের প্রথম ক্লাস। রমনা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বিজ্ঞানের টিচার হয়েও তিনি বেশ অবৈজ্ঞানিক একজন মানুষ। কারণ তিনি এমনকিছু নিয়মনীতি ফলো করেন যা অবৈজ্ঞানিক। অর্থাৎ যে ব্যাপার বিজ্ঞানের কোন বক্তব্য নেই। যেমন তিনি বিশ্বাস করেন, শিক্ষক ক্লাসে ঢুকার সাথে সাথে ছাত্ররা দাঁড়িয়ে সালাম কালাম দিবে, কুশল বিনিময় করবে। অথচ এ বিষয়টা কোন বিজ্ঞান বই থেকে জানা যায় না।
তিনি আরও বিশ্বাস করেন ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক হওয়া উচিৎ গুরু-শিষ্যেরের ন্যায়। শিক্ষক যেই চেয়ারে বসেন তাতে ছাত্র ভুলেও বসতে পারবে না। কিন্তু বিজ্ঞান এমনটা বলে না। বিজ্ঞান বলে যারই বসার ক্ষমতা আছে সে ইচ্ছা করলে যে কোন চেয়ারে বসতে পারবে। শিক্ষক হোক কিংবা ছাত্র। তাই তো তিনি প্রায়ই দেখেন দুষ্টু ছাত্ররা তার চেয়ারে বসে তাকে নকল করার চেষ্টা করছে।
যাইহোক এই অবৈজ্ঞানিক লোকটিই বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছে...
মাহফুজ স্যার বললেন; আজ আমরা শিখবো বিজ্ঞান কাকে বলে? অর্থাৎ বিজ্ঞানের সংজ্ঞা।
উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে যে, ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান।
এরই নাম বিজ্ঞান, বর্তমান বিশ্বে যার অবদান অপরিসীম। বিজ্ঞানের জন্যই আজ আমাদের জীবন যাত্রা এত উন্নত বুঝেছো তোমারা? ঠিক আছে, আজ তাহলে এ পর্যন্তই।
জুয়েল কটাক্ষের স্বরে বললো; আরে, সারাজীবন ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকলে বিজ্ঞানের মাহাত্ম্য বুঝবে কী করে?
রেগে গিয়ে আলামিন বললো; হুম তোরা খুব ভালো বিজ্ঞান বুঝিস। একারণেই তো বিজ্ঞানে সিক্সটি মার্ক (60) উঠাতে ঘাম বেড়িয়ে যায়। আর রবি বিজ্ঞান বুঝেনা দেখেই তো নাইন্টি মার্ক পায়।
কথাগুলো খুব গায়ে লাগে তাদের, তাই আলামিনের দিকে তেড়ে আসতেই রবি বললো; বাদ দে তো আলামিন। তারা তো প্রায় সময়ই বিজ্ঞানের এমন গুণগান গায়। দেখিসনি গতবার!
তারা বেরিয়েই যাচ্ছিলো এমন সময় পিছন থেকে রাফি বললো; কীরে রবি ভয় পেলি নাকি? তাদের হাসির আওয়াজে বিঘ্ন ঘটিয়ে রবি বললো; তোরা কী বলতে চাচ্ছিস, একটু ক্লিয়ার করবি?
রবি বেশ কনফিডেন্সের সাথে বললো; রাকিব, তোরা কী বলিস, আমি খালি মাঠে গোল দিব, নাকি মাঠ ভর্তি খেলোয়াড়, গেলারি ভর্তি দর্শকের সামনে গোল দিব? তাদের সমর্থন পেয়ে রবি বললো; শোন জুয়েল! তোদের এই প্রশ্নের জবাব আমি এত সহজেই দিব না। আমি চ্যালেঞ্জ করছি, তোরা তোদের আরও যত সাঙ্গপাঙ্গরা আছে সবাইকে নিয়ে শুক্রবার বিকেলে রোমনা পার্কের ঐ পুকুরটার কাছে চলে আসবি। সেখানেই আমি তোদের সব প্রশ্নের জবাব দিব ইনশাআল্লাহ।
ডিবেট করবি? ঠিক আছে, তোর চ্যালেঞ্জ আমরা এক্সেপ্ট করলাম। ডান; বলে চলে গেল তারা।
শুক্রবার বিকেলের পূর্বেই সবাই হাজির নির্ধারিত জায়গায়। সবার মধ্যে একটা উত্তেজনা কাজ করছে। মনে হচ্ছে সবাই মিলে টুরে এসেছে। যদিও প্রায় সময় তারা এখানে হাঁটতে আসে কিন্তু সবাই মিলে আজ একটা অন্যরকম পরিবেশ।
যাইহোক সবাই দু-পক্ষ হয়ে সারিবদ্ধ ভাবে বসলো। রবি তাদেরকে পুনরায় প্রশ্ন করতে বললে জুয়েল সেদিনকার প্রশ্নটাই রিপিট করলো; বিজ্ঞান এতকিছু আবিষ্কার করলো, ১৩ শো কোটি বছর পূর্বের ছবি বের করে ফেললো অথচ এখনো স্রষ্টার খোঁজ পেল না! স্রষ্টা যদি থেকেই থাকতো তাহলে তো বিজ্ঞান এতদিনে আবিষ্কার করে ফেলতো।
জুয়েলের আশেপাশে সবার বুক আত্মবিশ্বাসে দেড় হাত চওড়া হয়ে গিয়েছে। এবার রবির উত্তর দেয়ার পালা। সে বলতে শুরু করলো; সেদিন উইকিপিডিয়ার সূত্রে স্যার আমাদের বিজ্ঞানের সংজ্ঞা লিখিয়েছিলেন যার সারসংক্ষেপ ছিল এমন যে, ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, তার নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান।
'ভৌত বিশ্ব' বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে জড় পদার্থের সাথে সম্পৃক্ত বিশ্ব। তার মানে জড় পদার্থের বাহিরের কোনকিছু বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় নয়। তারপর বলা হয়েছে 'যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য' অর্থাৎ পর্যবেক্ষণযোগ্য নয় এমন জিনিসও বিজ্ঞানের আওতার বাহিরে।
এতটুকুন বলে থামলো রবি। এরপরই জুয়েলের পরিচিত এক বড়ভাই বললো; হয়তো মহাবিশ্বে জড় পদার্থ ছাড়া অন্যকিছু নেই। এবং পর্যবেক্ষণযোগ্য নয় এমন কোন জিনিসও নেই।
গণিতবিদ ও বিজ্ঞান-দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বিজ্ঞান কাকে বলে তা বুঝাতে গিয়ে বেশ সুন্দর ভাবে বলেছেন, বিজ্ঞান হচ্ছে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আবিষ্কারের চেষ্টা। এবং এর উপর ভিত্তি করে যুক্তি দেখানো... পৃথিবীর কোন নির্দিষ্ট ঘটনা সম্বন্ধে এবং ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট নিয়ম সম্বন্ধে। [১]
ঠিক অনুরূপ বিজ্ঞানও সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞানের কাজ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কোনকিছু আবিষ্কার করা। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা নিজেদের উপর আবশ্যক করে নিয়েছে যে, তাদের কাজ হবে কেবল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আবিষ্কারের চেষ্টা।
ধরুন আরেকটি গবেষক টিমের আবির্ভাব হলো যাদের কাজ দর্শনের (দেখার) মাধ্যমে কোনকিছু আবিষ্কার করা। অর্থাৎ তারা নিজেদের উপর আবশ্যক করে নিয়েছে যে, তারা কেবল দৃশ্য বস্তু নিয়েই কাজ করবে।
এখন বলুন, সত্যিকার অর্থে অদৃশ্য জিনিসের অস্তিত্ব অস্বীকার করার রাইট কি তাদের থাকবে?
সবার দিকে ইঙ্গিত করে প্রশ্নটি ছুড়ে দিলো রবি। কয়েকজন বললো; না, অস্বীকার করার রাইট তাদের থাকবে না। কারণ তারা শুরুতেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কেবল দৃশ্য বস্তু নিয়ে কাজ করার ব্যপারে।
প্রিয়া রবির দিকে ফিরে বললো; তুই যা বললি, সব আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে। কিছুই তো বুঝলাম না।
প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে রবি বললো; তুই তো ইলিশ মাছ খাছ না। তাই না? সে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললো; হুম, ইলিশ মাছে প্রচুর কাঁটা। কাঁটা ওয়ালা মাছ আমি খেতে পারি না।
তুই ইলিশ মাছ খাছ না এবং ভবিষ্যতেও খাবি না। এটা তোর প্রতিজ্ঞা। সুতরাং তোর কি একথা বলার অধিকার থাকবে যে, ইলিশ মাছে স্বাদ নেই?
সে সহজ ভাষায় বললো; না, আমি এটা বলতে পারি না। কারণ আমি তো ইলিশ মাছ খাই না। তাহলে না খেয়ে কীভাবে এমন মন্তব্য করবো?
রবি মুস্কি হাসি দিয়ে বললো; বিজ্ঞানের বিষয়টিও তোর মতো। বিজ্ঞানও জড় বস্তু ছাড়া অন্যকিছু খায় না। অর্থাৎ বস্তু জগৎ ছাড়া অন্যকিছু নিয়ে গবেষণা করে না। তাহলে তার কী করে অবস্তু জগতকে ঘিরে মন্তব্য করার অধিকার থাকবে! স্রষ্টা আছে কি নেই এ ব্যাপারে তো তার কোন মন্তব্য থাকার কথা না। বিজ্ঞান কী করে স্রষ্টা, আত্মা, জ্বীনের ব্যাপারে মন্তব্য করবে? সে তো বস্তু ছাড়া অন্যকিছু খায়ই না।
তবে তখন বিজ্ঞান স্রষ্টা, আত্মা, জ্বীন সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারবে যখন স্রষ্টা, আত্মা, জ্বীন বস্তু হয়ে বিজ্ঞানের কাছে ধরা দিবে। যেমন, প্রিয়া তখন ইলিশ মাছ খেয়ে মন্তব্য করতে পারবে যখন একটা কাঁটামুক্ত ইলিশের জন্ম হবে। পরিশেষে এতটুকুই বলতে চাই, প্রিয়ার মন্তব্যের স্বার্থে যেমন কাঁটাযুক্ত ইলিশ কাঁটামুক্ত হয়ে যাবে না। বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণের স্বার্থেও তেমন স্রষ্টা, আত্মা, জ্বীন বস্তুতে সীমাবদ্ধ হবে না।
পুরো বক্তব্য শেষ করে রবি বসে পড়লো। এদিকে প্রিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখন বুঝতে পেরেছে। বাদবাকিরাও আর কোন কথা বাড়ালো না। এমনিতেও অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেছে। এবার বাসায় ফেরার পালা।
COMMENTS