NCTB-এর ক্লাস সেভেনের 'ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ' বইটা পড়ে আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম যে, এটা কি বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক, নাকি ভারতের?
বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে শেষ পৃষ্ঠা অব্দি কোথাও আপত্তি থেকে খালি নেই। প্রাপ্তবয়স্ক বুদ্ধিমান যে কেউ বইটি পড়া মাত্রই বুঝতে পারবেন- ইসলাম কুপানোর পরিকল্পনা নিয়েই লেখকগন মাঠে নেমেছেন।
তবে আলোচ্য বিষয়ের সাথে বইয়ের নামটা “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” বেমানান হয়েছে।
বইয়ের মধ্যে লজ্জাজনক হারে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। যার ফলে মুসলিম শাসন ব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। অতি কৌশলে হিন্দু, বৌদ্ধ সভ্যতা ও ইতিহাসের প্রতি মুগ্ধতা সৃষ্টি করা হয়েছে। পাশাপাশি মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। একদিকে হিন্দু বৌদ্ধ বিধর্মীদের প্রশংসা অপরদিকে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা, বেশ চমৎকার ভাবেই বাচ্চাদের মগজ ধোলাই করতে সাহায্য করবে।
যাইহোক, এখন চলুন দেখি উক্ত বইয়ের মধ্যে কী আছে, কী নেই?
Ridwan Haider Khandkar ভাইয়ের লেখাটি পড়ুন। খুব চমৎকার ভাবে তিনি গোটা বইটি সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করেছেন।
১। প্রচ্ছদ দেখে প্রথম খটকাটি খেয়েছি। মৌর্য সাম্রাজ্যের আমলের বৌদ্ধ সমাজের পাটলিপুত্র মন্দিরের ছবি। এটা না আমাদের দেশের ইতিহাস সঠিকভাবে রিপ্রেজেন্ট করে না বর্তমান সমাজ। আমি বলছি না মসজিদের ছবি দিন বা মন্দিরের, দরকার নেই। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট রিপ্রেজেন্ট করে এমন কিছুও দেয়া যেতো। প্রচ্ছদের ময়ূর, পদ্ম ফুল, জবা ইত্যাদি আমাদের জাতীয় পাখি বা ফুলও নয়।
.
২। বইয়ে চারটি প্রধান অধ্যায়—
• প্রথমঃ নগর সভ্যতার উত্থান-পতন: দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষের জীবন, অর্থনীতি ও পরিচয়ের রূপান্তর।
• দ্বিতীয়ঃ সাম্রাজ্যের বিস্তার, নগর-রাষ্ট্র আর বৈচিত্র্য: পরিচয়, ভাষা, জীবনের অবিরাম বদল
• তৃতীয়ঃ আঞ্চলিক পরিচয়, চাষাবাদের বিস্তার এবং তৃতীয় নগরায়ণ: যোগাযোগ, মিশ্রণ আর প্রতিযোগিতার পর্ব
• চতুর্থঃ সম্পর্ক, মিশ্রণ ও নতুন ধারণা : সুলতানী আমল ও বাংলা
প্রথম তিনটি অধ্যায় মিলে ১০৯ পৃষ্ঠা। আর চতুর্থ অধ্যায়টি মাত্র (১১০-১২৪) ১৪ পৃষ্ঠা।
.
৩। প্রথম অধ্যায়ের মূল বিষয় হলো উপমহাদেশের আদিম সংস্কৃতি ও সভ্যতা তথা হরপ্পা সভ্যতা। তারা খুবই সভ্য আর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছিল। তাদের ছিল অনেক সুন্দর সুন্দর ড্রেইন। সেখান দিয়ে পায়খানা যাওয়া আসা করতো। সকলের সম্মানজনক ভাবে চলতো। সবার ছিল স্বাধীনতা। ছিল বিস্তৃত রাস্তাঘাট, পানি সরবরাহ, ডাস্টবিন, সূক্ষ্ম পরিমাপ পদ্ধতি, শিল্পকলা ইত্যাদি। মূলত তারা ছিল উৎকৃষ্ট এক জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠী মূলত প্রাকৃতিক কারণে ধীরে ধীরে পতিত হয়েছে। তাদের এবং আর্যদের মিশ্রণে গঠিত সমাজের ধর্ম বেদের উপর নির্ভরশীল। বেদের প্রকারভেদ নিয়েও বেশ ভালো আলোচনা কয়েকবার এসেছে।
.
৪। দ্বিতীয় অধ্যায়ের বিষয় হলো (হিন্দু ও) বৌদ্ধ ধর্ম ও শাসনব্যবস্থা। বৌদ্ধ ধর্ম খুবই ভালো, পরম অহিংসার ধর্ম। গৌতম বুদ্ধের জীবনীর অনেক snippets এখানে সেখানে আছে। আগের অধ্যায়ের মতোই এই অধ্যায়েও এই সমাজের প্রচণ্ড বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। ক্লাস সেভেনের জন্য এত বিস্তারিত আলোচনা কেন জরুরী আমার বোধগম্য হলো না।
.
৫। তৃতীয় অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে তৎকালীন সভ্যতার নগরায়ন আর ধর্মীয় স্থাপনার চিত্র আর বর্ণনা। ভারত উপমহাদেশে ও বাংলায় শশাংক রাজত্ব। এখানে মুদ্রা, মন্দির, স্থাপনা, ধর্মিয় গ্রন্থ, দেব-দেবীর ছবি, বৌদ্ধ বিহার আর মন্দিরের ছবিতে সয়লাব। প্রতিমা, মূর্তি, দেব-দেবীর আলোচনাই মুখ্য এই অধ্যায়ে।
.
৬। একশ চব্বিশ পৃষ্ঠার ১০৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়লে একে সামাজিক বিজ্ঞানের চাইতে ধর্মীয় ইতিহাসের বই বললেই বেশি সঠিক হবে বলে ধারণা হয়েছে।
.
৭। অবশেষে চতুর্ধ অধ্যায়ঃ সুলতানী আমল। শুরুই হয়েছে এভাবেঃ “তোমাদের যদি জিজ্ঞেস করি, ‘বিদেশি' বলতে তোমরা কাদের বোঝাবে? তোমরা চোখ বন্ধ করে বলবে, বিদেশি হলো তারাই যারা আমাদের দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের বাইরে থেকে এই দেশে এসেছে। তোমাদের উত্তর একদম সঠিক। কিন্তু সুলতানী আমলে যদি কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো ‘বিদেশি' কে? তাহলে সে কী বলত জানো? সে বলত, অপরিচিত কোনো ব্যক্তি যে আমাদের গ্রামে বা অঞ্চলে থাকে না, আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অংশ নয়, সেই বিদেশি।” (পৃষ্ঠা ১১১)
অর্থাৎ, এতক্ষন পর্যন্ত যা পড়লাম সবকিছুই আমাদের দেশীয়, আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এখন যা আসছে সব ভিনদেশি, অন্য সংস্কৃতির জিনিস। আমাদের উপর “সুলতানী তথা ইসলামী সংস্কৃতি” চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
.
৮। সুলতানী শাসন ব্যবস্থা এদেশে কীভাবে উড়ে এসে জেঁকে বসেছিল তার ধারণা এখন আসছেঃ
“তোমরা তো আগেই জেনেছে, সুলতানী আমলের আগে এই অঞ্চলে পাল ও সেন শাসকগণ শাসন করতেন। কিন্তু সুলতানরা ছিলেন মুসলিম। তাই নতুন শাসকগণ ক্ষমতায় এসে দেশের আইন-কানুন এবং বিচার ব্যবস্থা পুরোটা পাল্টে ফেললেন। এই আমলে শরীয়ত অনুসারে দেশ পরিচালিত হতো। কিন্তু শাসনব্যবস্থা মোটেও ধর্মতান্ত্রিক ছিল না। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যেহেতু অমুসলিম ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই সবাই সবসময় সুলতানদের শাসন মেনে নিতে চাইত না।” (পৃষ্ঠা ১১২)
.
৯। বর্ণনাভঙ্গী থেকে মনে হবে সুলতানী আমলের আগে সবাই ছিল উদারপন্থী ও গণতান্ত্রিক। কিন্তু সুলতানগন যা ইচ্ছা তা-ই করতো। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তারাঃ
“সুলতানগণ ছিলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এখন মনে হতে পারে, ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’ আবার কী? বন্ধুরা, সার্বভৌম ক্ষমতা হলো সর্বময় ক্ষমতা। যে ব্যক্তি এই ক্ষমতার অধিকারী তারা তাদের ক্ষমতার জন্য কারও কাছে জবাবদিহিতা করতে হয় না। তার ইচ্ছাতেই সবকিছু হয়। তিনি যেমন চান, তেমনই হয়।” (পৃষ্ঠা ১১৩)
.
১০। সুলতানী আমলের একমাত্র ভালো জিনিস ছিল যে সে সময়ে উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম একজন নারী শাসক বনে যান। তার নাম রাজিয়া সুলতানা। ১২৩৬ থেকে ১২৪০ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লীর সালতানাতের দায়িত্বে ছিলেন। শাসক হিসেবে ছিলেন প্রসিদ্ধ, সুলতানের পোশাকে দরবারে উপস্থিত হতে। যুদ্ধশাস্ত্রে ছিলেন পারদর্শী। যুদ্ধের মাঠে সেনাপতি হতেন।
.
১১। উপমহাদেশের ইতিহাসে সবসময়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসন থাকলেও তাদের বর্ণনাভঙ্গী থেকে মনে হবে বর্ণবাদের শুরু হয় সুলতানী আমল থেকেঃ
“ইতিহাসবিদদের গবেষণা অনুযায়ী, এ সময়ে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীর মানুষ বসবাস করলেও মুসলমানগণ অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। আর এর কারণ কিন্তু একটু আগেই বলা হয়েছে। সেই কারণটা মনে আছে তো? আচ্ছা, কারণটা আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছি। সুলতানী আমলের শাসকগণ সবাই ছিলেন মুসলিম এবং সে জন্যই মুসলিমরা অন্যদের থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল।
মুসলমান সমাজে মূলত দুইটি শ্রেণী ছিল। একভাগে ছিল বাইরে থেকে আসা অভিজাত সম্প্রদায় … অন্যভাগে ছিল স্থানীয় ধর্মান্তরিত সাধারণ শ্রেণী। অভিজাত শ্রেণী নিজেদের আশরাফ ও অন্যদের আতরাফ মনে করতেন। আশরাফ ও আতরাফদের মধ্যে মেলামেশা, বিয়েশাদী, দাওয়াতের আদানপ্রদান একেবারেই ছিল না। বর্তমানেও এ ধরনের বিভাজন আমরা দেখতে পাই। সমাজের ‘দলিতদেরকে' অন্ত্যজ ও অপাংক্তেয় মনে করা হয়।” (পৃষ্ঠা ১১৫)
.
১২। বর্ণবাদের আলোচনা যেহেতু এসেছেই তাই হিন্দুদের বর্ণবাদও আসা উচিত। তবে হিন্দু সমাজে বর্ণপ্রথা “সুলতানী আমলে” অত্যন্ত কঠোর ছিল। (পৃষ্ঠা ১১৯)
.
১৩। বর্ণভেদ ও সতীদাহের মতো বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ একই ধরণের জঘন্য কাজ। আর এসব জঘন্য কাজ দূর করেছিল হিরোরা। সেই হিরোরা ছিল খোদ হিন্দুদের মধ্যে রাজা রামমোহন রয়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আর অন্য হিরো ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ।
.
১৪। যেন “অমানবিক দাসপ্রথা” সুলতানী আমলেই চালু হয়েছিল। এই অমানবিক দাসপ্রথাও আমাদের ব্রিটিশ মনিবগন নিষিদ্ধ করেনঃ
.
“… ইতিহাসের এই মন্দটুকুও তোমাদের জানতে হবে। সুলতানি আমলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। তোমরা হয়তো জানতে চাইতে পারো দাসপ্রথা কী? দাসপ্রথা হলো অমানবিক একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে বাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে মানুষের কেনা-বেচা হতো। এই ব্যবস্থায় ধনীরা ব্যক্তিকে কিনে নিত এবং ক্রীত ব্যক্তি তার সম্পত্তি হিসেবে যেকোনো কাজ করতে বাধ্য থাকত। সুলতানি আমলেও এই দাসপ্রথার মাধ্যমে মানুষের কেনা-বেচা হতো। দাসগণ অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করত। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য ছিল না। সুলতানি আমল ও মোগল আমল শেষে ব্রিটিশ উপনিবেশের মধ্যমভাগে আইন করে এই অমানবিক প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়।” (পৃষ্ঠা ১১৯)
.
পাঠ্যবইতে সুলতানী আমলের দাসপ্রথা উল্লেখ করা হলেও এর পূর্বে হিন্দু শাসকদের সময়কার দাসপ্রথার ব্যাপারটা কোনো এক বিচিত্র কারণে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে পড়ুনঃ https://www.frommuslims.com//হিন্দুধর্মের-দাসপ্রথা/
.
১৫। সুলতানী আমলে নারীদের অবস্থা ছিল অনেক শোচনীয়। (পৃষ্ঠা ১২০)
.
১৬। প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসনব্যবস্থার অর্থনৈতিক আমলের বিস্তারিত বর্ণনা থাকলেও সুলতানী আমলের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বহিরাগত পর্যটকের উৎস বাদে তেমন কিছুই জানা যায় না। (পৃষ্ঠা ১২০)
.
১৭। পুরো বইয়ের শতাধিক ছবি আছে। আছে অনেক মন্দিরের ছবি, অনেক অনেক দেবদেবী, মূর্তি-প্রতিমার ছবি। মসজিদের ছবি আছে তিনটা। নির্দিষ্ট করে বললেঃ
.
১২৪ পৃষ্ঠার বইতে ১৯২+/- টি ছবি
৩৪টি ম্যাপের ছবি
১৮টি মন্দির+প্যাগোডার ছবি
৩টি মসজিদের ছবি
১৫টি ধর্মীয় মূর্তি/প্রতিমা
৩৮টি মুদ্রা
.
১৮। যেতে যেতে সুলতানী আমল কত খারাপ সেটা আবার বলে যাই। যদিও “ইবনে বতুতা সুলতানী আমলে বাংলার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর মতে বাংলায় যত সস্তায় জিনিসপত্র কিনতে পাওয়া যেত, তা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যেত না। কিন্তু সস্তায় জিনিসপত্র কেনার মতো সামর্থ্য কতজনের ছিল তা অবশ্য কোনো পর্যটকের লেখায় পাওয়া যায় না। … সে-সময়ে সোনা, রূপা এবং তামার পয়সার প্রচলন ছিল। … তবে সাধারণ মানুষ কড়ির মাধ্যমে বিনিময় করত। সমাজে শ্রেণীবৈষম্য প্রকট ছিল। সমাজের একদিকে যেমন বিত্তবানদের বিলাসী জীবন, ঠিক তেমনি উল্টো দিকে সংগামী মানুষ দুমুঠো খাবারের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করত।” (পৃষ্ঠা ১২১)
.
১৯। অত্যন্ত সুক্ষভাবে সুলতানী আমলের নামে মুসলিম বিদ্বেষ ঢোকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
.
২০। হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা ও ইতিহাসের প্রতি মুগ্ধতা সৃষ্টির চেষ্টা করানো হচ্ছে।
২১। ১২৪ পৃষ্ঠার বইতে ১৯২+/- টি ছবি
৩৪টি ম্যাপের ছবি
১৮টি মন্দির+প্যাগোডার ছবি
৩টি মসজিদের ছবি
১৫টি ধর্মীয় মূর্তি/প্রতিমা
৩৮টি মুদ্রা
#সত্যমনা ব্লগ।
COMMENTS